Tuesday, July 14, 2020

সমাজের 'ডাইনি' হত্যা - অপর্ণা পাল

সাধারণত আমরা কোনোদিনও কোনো ভূতেদের ধরা পড়তে দেখিনি। শুধুমাত্র গ্রামের নানা স্থানে ডাইনিরা ধরা পড়েছে। আজও একুশ শতকের সভ্যতায় গ্রামে গাছে গাছে সব ডাইনি বাঁধা থাকে। পরদিন খবরের কাগজে শিক্ষিত সমাজ পড়তে থাকে সেই ঘটনার হেডলাইন - "ডাইনি সন্দেহে পুড়িয়ে হত্যা"।

 এই সন্দেহ কথাটির বড় অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে কাদের সন্দেহ? কোনদিন কেন কাউকে ব্রহ্মদৈত্য সন্দেহ করা হয় না কিংবা রাক্ষস। শুধুমাত্র শোনা যায় ওঝা 'ডাইনি' ধরেছে। গ্রামের সবলোক জড়ো হয় কোনো এক বটতলাতে, উল্লাসের সথে তারা পুড়িয়ে মারে গ্রামের সেই ডাইনীকে। এই গল্প যুগ যুগ ধরে চলে আসছে।
 এখন প্রশ্ন হচ্ছে নারীরাই কেন এর শিকার হয়ে আসছে... এর উত্তরে বলা যায়, পিতৃকেন্দ্রিক মানসিকতা, অশিক্ষা, কুসংস্কার এর প্রধান কারণ। এছাড়া অন্য কিছু কারণ হল, মেয়েদের সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা। আবার কখন গ্রামাঞ্চলের মানসিক স্বাস্থ্য বা হরমোনজনিত কারণে মেয়েদের স্বভাব এর কছু পরিবর্তন দেখা দিলে তা ডাইনির লক্ষণ বলে ধরে নেওয়া হয়।

এবার দেখা যাক, ইতিহাসের প্রথম সেই মহিলা যাকে বাইবেলে 'ডাইনি' আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। যে এই মানব সভ্যতার 'প্রথম ডাইনি'। যে নিজের অধিকার, অস্তিত্ব নিয়ে সচেতন ছিল। জিউশ বাইবেলে তার পরিচয় পাওয়া যায়। সেই নারী হল লিলিথ। অ্যাডামের প্রথম স্ত্রী লিলিথ। জানা যায়, ঈশ্বরের বাগানের যে মাটি দিয়ে ঈশ্বর অ্যাডামকে গড়েছিলেন সেই মাটি থেকেই তৈরি করেন তিনি লিলিথকে। ঈশ্বরের সৃষ্ট প্রথম নারী ও পুরুষ‌ অ্যাডাম ও লিলিথ। কিন্তু স্বভাবতই পুরুষ হওয়ার ফলে অ্যাডাম কর্তৃত্ব ফলাতে শুরু করলে লিলিথ তা মেনে নিতে চায় না। নিজের অবস্থান সম্পর্কে সচেতন লিলিথ জানায় একই মাটি দিয়ে তারা পরস্পর সৃষ্ট, ফলে আমরা দুজন সমান। এরপরে প্রতিবাদ গর্জে ওঠে লিলিথের মুখে। নিজের ডানা তৈরি করে এবং পাখা মেলে উড়ে যায় লিলিথ। অ্যাডামের পদতলে থাকতে হবে ভেবে সে স্বেচ্ছায় ত্যাগ করে ঈশ্বরের বাগান। ফলে ঈশ্বর অপমানিত হন, ঈশ্বর তাকে নানা অভিশাপ দেন এবং সৃষ্টি হয় শতাব্দীর প্রথম ডাইনি।

 আসলে সমাজ যখন কোনো মেয়েকে সামলাতে পারেনি, তখনই তাকে ডাইনি বলে দাগিয়ে দিয়েছে। আর এই দাগিয়ে দেওয়ার ভয়েই সমাজ মেয়েদের শিকল পরিয়ে রেখেছে। তবুও আজ ও সমাজের কোথাও কোথাও প্রতিবাদে গর্জে ওঠে এই লিলিথের সম্প্রদায়।
একটি গণনা অনুযায়ী দেখা গেছে ভারতে ১৯৯৫ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে ডাইনি সন্দেহে হত্যা হয়েছে প্রায় আড়াই হাজার মানুষ। এর মধ্যে অবশ্য যারা ডাইনি সন্দেহে অত্যাচারিত, নিপীড়িত তাদের হিসেবটা ধরা হয়নি। বিহার,  ছত্রিশগড়, ঝাড়খন্ড, উড়িষ্যা, আসাম এইসব রাজ্যগুলিতে এই ঘটনা ঘটেই চলছে। পিছিয়ে নেই পশ্চিমবঙ্গ। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলাতেও এই জাতীয় ঘটনা দেখা যায়। বিশেষ করে পাহাড়ি অঞ্চলে এই ঘটনা বেশি দেখা যায়। কোনো কোনো সময় তা প্রশাসনের চোখে পড়লে মানুষের কিছুদিন হৈচৈ শোনা যায় তারপর আবার সবাই চুপচাপ হয়ে যায়।

শুধুমাত্র ভারতবর্ষে নয় গোটা পৃথিবীতেই 'ডাইনি'দের ছবি ধরা পড়ে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সংস্কৃতিতে তা অন্য মাত্রা পেয়েছে। কখনো, উনিশ শতকে ইউরোপে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করা মহিলাদের ডাইনি বলে তুলে এনে পুড়িয়ে ফেলা হতো। কখনো, আমেরিকার নারীবাদী আন্দোলনের ঢেউ উঠলে তাদের ডাইনি বলে সম্মোধন করা হতো। গর্ভরোধ বা গর্ভপাতের দাবিতে যারা প্রথম সোচ্চার হন, সেইসব নারীদের ডাইনি বলে হত্যালীলা চালানো হয়। যেসব নারীরা প্রথম নারীদের যৌনতৃপ্তির কথা তুলে ধরেন সমাজের সামনে তাদের ডাইনি বলে গুম করে ফেলা হয়। আবার এদেশে দেখা গেছে, উত্তরপ্রদেশে কোনো মহিলা স্বামীর মৃত্যুর পরে সম্পত্তির দাবি করলে তাকে ডাইনি বলে পিটিয়ে ফেলা হয়েছে। আবার গ্রামাঞ্চলে কখনো কেউ অসামাজিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লে সমাজের চোখে সেই হয়ে ওঠে ডাইনি। এভাবে যখনই কোন সংস্কৃতিতে নারীরা পুরুষের অনুশাসন থেকে বেরিয়ে স্বাবলম্বী হয়ে কিছু করতে চেয়েছে সমাজ তাকে ডাইনি বলে অপবাদে জর্জরিত করেছে, সাথে চলেছে এক জঘন্য হত্যালীলা।

তবে বর্তমানে এই সমস্যা আইনি পদক্ষেপ দ্বারা কিছুটা কমানো গেছে। 'ডাইনি প্রতিরোধ আইন' দ্বারা সরকার এইসব ঘটনা গুলি কিছুটা সমাধান করতে চেষ্টা করলেও বিভিন্ন সময়ে সঠিক প্রমাণের অভাবে দোষীদের সনাক্তকরণ করা যায়নি। আবার কখনও সমাজের উচ্চস্থানীয় পদের নানা ব্যক্তিরা এই দোষীদের শাস্তি পেতে দেয়নি। তাই এই প্রথার অবসান ঘটাতে গেলে আগে সমাজকেই সচেতন হতে হবে। আমাদের সমাজ যদি এক উন্নত মানসিকতায় পরিপূর্ণ সমাজে পরিণত হয়। তবেই এই ডাইনি প্রথা একদিন পৃথিবী থেকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
  • তথ্যসূত্র - ১.আনন্দবাজার পত্রিকা সংস্করণ।
                   ২. বিকাশপিডিয়া।
                   ৩. উইকিপিডিয়া।
  • চিত্রসূত্র - উইকিপিডিয়া।

Shilajit Resin

Shilajit Resin Tap into your full potential with India’s first clinically researched, purified shilajit resin, sourced from 18,000 feet of t...