দেশের এই করোনা বিপর্যয়ের কারণে লোকজনের জমায়েত প্রায় বন্ধ। তাই নানা উৎসব অনুষ্ঠান বর্তমানে স্থাগিত রাখা হয়েছে, যেমন তার মধ্যে বিবাহের অনুষ্ঠান অন্যতম। এই বৈশাখ, জৈষ্ঠ মাস হিন্দুদের বিবাহের জন্য এক অন্যতম সময় কিন্তু এই পরিস্থিতিতে তা মূলত সম্পূর্ণরূপে ব্যাহত হচ্ছে। তাই অনেকের বিবাহ তারিখ নির্ধারণ হওয়ার ফলে ও বিবাহের লৌকিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন হচ্ছে না। এই বিবাহ মানব সমাজের প্রাচীনতম এক নিয়ম। যুগে যুগে এর আদিরূপ থেকে বর্তমান কাঠামোয় উপনীত হয়েছে। বিভিন্ন ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় আইনের পাশাপাশি লোকজ সংস্কৃতি ও বৈবাহিক জীবনকে প্রভাবিত করেছে নানাভাবে। কিন্তু মনে রাখার বিষয়, বর্তমানের বিবাহ রীতিই কিন্তু হিন্দুদের একমাত্র বিবাহ পদ্ধতি নয়। বৈদিক দর্শন অনুযায়ী প্রধানত বিবাহের ১০ টি ধরণ রয়েছে। আবার 'মনুস্মৃতি' এবং 'অর্থশাস্ত্রে'র আট প্রকার বিবাহ রীতি উল্লেখ করা হয়েছে। এই আট প্রকার বিবাহ রীতি যে বর্ণনা রয়েছে সেগুলি হল-
১. ব্রাহ্ম বিবাহ - কন্যাকে বিশেষ বস্ত্র দ্বারা আচ্ছাদন করে স্বর্ণ অলংকার ইত্যাদি দ্বারা সজ্জিত করে, বরকে স্বয়ং আমন্ত্রণ করে এনে, বেদ পাঠ করে মঙ্গলাচরণের মাধ্যমে কন্যা দান করা হয় তাকে ব্রাক্ষ বিবাহ বলে।
২. প্রজাপত্য বিবাহ - যখন পাত্র, কন্যার পাণিপ্রার্থী হয়, তখন কন্যার পিতার সম্মতিতে যে বিবাহ হয়, তাকে প্রজাপত্য বিবাহ বলে। এই বিবাহ প্রথা বর্তমানে বাঙালি হিন্দু সমাজে প্রচলিত আছে।
৩. আর্য বিবাহ - এই বিবাহ বরের নিকট হতে একবার মাত্র দুটি গাড়ি বা ষাঁড় গ্রহণ করে যথাবিধি যজ্ঞ করে কন্যা দান করা হয়, তাকে আর্য বিবাহ বলে। এই বিবাহ অশ্ব বিবাহ নামেও পরিচিত। এই বিবাহ প্রথা শুধুমাত্র ভারতের বিহারীদের মধ্যে প্রচলিত।
৪. দৈব বিবাহ - এই বিবাহ পদ্ধতিতে পিতা নিরালঙ্কারা কন্যাকে যজ্ঞের অগ্নির সম্মুখে কোন সাধু-সন্ন্যাসীকে দান করে, এই বিবাহ প্রথা বেশিরভাগ সময়ই দেবতারা মানব কন্যা গ্রহণের সময়েই প্রযোজ্য ছিল। বর্তমানে এই প্রথার প্রচলন নেই বললেই চলে।
৫. গান্ধর্ব বিবাহ - পিতা-মাতার অজ্ঞাতে কোন যুবক-যুবতী যখন গোপনে প্রেম করে এবং কিছু সময় পর গুরুজনদের অজান্তে পালিয়ে বিয়ে করে, সেই বিবাহকে গান্ধর্ব বিবাহ বলে। আবার কোথাও কোথাও যুবক-যুবতীর সম্মতিতে বিবাহের পূর্বে একত্রে সহবাস করাকেও কেউ কেউ গান্ধর্ব বিবাহ বলা হয়ে থাকে।
৬. আসুরিক বিবাহ - কন্যা পিতাকে পণ বা যৌতুক প্রদান করে পাত্র যদি বিবাহ করে, তাকে অসুর বা আসুরিক বিবাহ বলে। অনেক সময় পাত্র আকৃষ্ট থাকলে মেয়েটির প্রতি তখন কোনো আত্মীয়কে নানা প্রলোভন দেখিয়ে বা ভুলিয়েও এই প্রকার বিবাহ করে থাকে। এই প্রকার বিবাহ বর্তমানেও বহু হয়ে থাকে কিন্তু তা বুঝতে বা জানতে পারা যায় না।
৭. বৈশাখ বিবাহ - কন্যাকে অচেতন করে বা মানসিক ভাবে অসুস্থ করে, গোপনে তাকে বিবাহ করা হলে তাকে পৈশাচিক বিবাহ বলা হয়। এক্ষেত্রে দুজন প্রথমে প্রেম করবে, তারপর সুযোগ বুঝে গোপনে নারীকে মাদকদ্রব্য খাইয়ে অর্ধজ্ঞানহীন করে যৌনমিলন করা হয়ে থাকে। এরপর পুরোহিত ডেকে সেই নারীকে বিবাহ করা হয়। এক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময়ই নারীকে বাধ্য হয়ে বিবাহ করতে হয়। এ বিবাহ প্রথা সাধারণত বাৎসায়নের যুগে ছিল।
৮. রাক্ষস বিবাহ - কন্যার পিতাকে আহত বা হত করে, কন্যাকে বলপূর্বক হরণ করে বিবাহ করাকে রাক্ষস বিবাহ বলা হয়। এক্ষেত্রে কোনো রূপসী নারীকে লাভ করা দুষ্কর হলে, তাকে পুরাকালে ক্ষত্রিয় রাজারা এইভাবে বাহুবলে ধরে এনে বিবাহ করত। বর্তমানে এর প্রচলন নেই বললেই চলে।
এছাড়া বেদে আরও দু ধরনের বিবাহের কথা বলা আছে যা হল -
ক. অনুলোম বিবাহ - কোনো উচ্চবর্ণের পুরুষ যদি নিম্নবর্ণের কোনো নারীকে বিবাহ করে, তখন তাকে অনুরোধ বিবাহ বলা হত।
খ. প্রতিলোম বিবাহ - সমাজের উচ্চবর্ণের নারী যখন কোনো নিম্নবর্ণের পুরুষকে বিবাহ করত, তখন তাকে প্রতিলোম বিবাহ বলা হয়ে থাকে।
যদিও তৎকালীন সময়ে ধর্ম অনুযায়ী এই অনুলোম ও প্রতিলোম বিবাহ সমাজে স্বীকৃত ছিল না।
বিবাহের এই একাধিক পদ্ধতি দেখা গেলেও বর্তমানের আধুনিক সমাজে প্রজাপত্য বিবাহের প্রচলনই দেখা যায়। সমাজে উন্নতির সাথে সাথে অন্যান্য বিবাহ প্রথার বিনাশ ঘটলেও একেবারে বিলুপ্ত সাধন যে ঘটেনি, তা আজকাল খবরের কাগজে 'বলপূর্বক বিবাহ', 'পণ দ্বারা বিবাহ' ইত্যাদি খবর থেকেই বোঝা যায়। তবে আশা করা যায় পরবর্তী শতকে সমাজের মানসিকতার উন্নতি সাধন ঘটলে এ ধরনের অসামাজিক বিবাহ পদ্ধতির সম্পূর্ণরূপে সমাপ্তি ঘটবে।
তথ্যসূত্র-১. বাংলাপিডিয়া।
২. উইকিপিডিয়া।