Tuesday, June 16, 2020

বিবাহ

দেশের এই করোনা বিপর্যয়ের কারণে লোকজনের জমায়েত প্রায় বন্ধ। তাই নানা উৎসব অনুষ্ঠান বর্তমানে স্থাগিত রাখা হয়েছে, যেমন তার মধ্যে বিবাহের অনুষ্ঠান অন্যতম। এই বৈশাখ, জৈষ্ঠ মাস হিন্দুদের বিবাহের জন্য এক অন্যতম সময় কিন্তু এই পরিস্থিতিতে তা মূলত সম্পূর্ণরূপে ব্যাহত হচ্ছে। তাই অনেকের বিবাহ তারিখ নির্ধারণ হওয়ার ফলে ও বিবাহের লৌকিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন হচ্ছে না। এই বিবাহ মানব সমাজের প্রাচীনতম এক নিয়ম। যুগে যুগে এর আদিরূপ থেকে বর্তমান কাঠামোয় উপনীত হয়েছে। বিভিন্ন ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় আইনের পাশাপাশি লোকজ সংস্কৃতি ও বৈবাহিক জীবনকে প্রভাবিত করেছে নানাভাবে। কিন্তু মনে রাখার বিষয়, বর্তমানের বিবাহ রীতিই কিন্তু হিন্দুদের একমাত্র বিবাহ পদ্ধতি নয়। বৈদিক দর্শন অনুযায়ী প্রধানত বিবাহের ১০ টি ধরণ রয়েছে। আবার 'মনুস্মৃতি' এবং 'অর্থশাস্ত্রে'র আট প্রকার বিবাহ রীতি উল্লেখ করা হয়েছে। এই আট প্রকার বিবাহ রীতি যে বর্ণনা রয়েছে সেগুলি হল-
১. ব্রাহ্ম বিবাহ - কন্যাকে বিশেষ বস্ত্র দ্বারা আচ্ছাদন করে স্বর্ণ অলংকার ইত্যাদি দ্বারা সজ্জিত করে, বরকে স্বয়ং আমন্ত্রণ করে এনে, বেদ পাঠ করে মঙ্গলাচরণের মাধ্যমে কন্যা দান করা হয় তাকে ব্রাক্ষ বিবাহ বলে। 


২. প্রজাপত্য বিবাহ - যখন পাত্র, কন্যার পাণিপ্রার্থী হয়, তখন কন্যার পিতার সম্মতিতে যে বিবাহ হয়, তাকে প্রজাপত্য বিবাহ বলে। এই বিবাহ প্রথা বর্তমানে বাঙালি হিন্দু সমাজে প্রচলিত আছে।


৩. আর্য বিবাহ - এই বিবাহ বরের নিকট হতে একবার মাত্র দুটি গাড়ি বা ষাঁড় গ্রহণ করে যথাবিধি যজ্ঞ করে কন্যা দান করা হয়, তাকে আর্য বিবাহ বলে। এই বিবাহ অশ্ব বিবাহ নামেও পরিচিত। এই বিবাহ প্রথা শুধুমাত্র ভারতের বিহারীদের মধ্যে প্রচলিত।
৪. দৈব বিবাহ - এই বিবাহ পদ্ধতিতে পিতা নিরালঙ্কারা কন্যাকে যজ্ঞের অগ্নির সম্মুখে কোন সাধু-সন্ন্যাসীকে দান করে, এই বিবাহ প্রথা বেশিরভাগ সময়ই দেবতারা মানব কন্যা গ্রহণের সময়েই প্রযোজ্য ছিল। বর্তমানে এই প্রথার প্রচলন নেই বললেই চলে।
৫. গান্ধর্ব বিবাহ -  পিতা-মাতার অজ্ঞাতে কোন যুবক-যুবতী যখন গোপনে প্রেম করে এবং কিছু সময় পর গুরুজনদের অজান্তে পালিয়ে বিয়ে করে, সেই বিবাহকে গান্ধর্ব বিবাহ বলে। আবার কোথাও কোথাও যুবক-যুবতীর সম্মতিতে বিবাহের পূর্বে একত্রে সহবাস করাকেও কেউ কেউ গান্ধর্ব বিবাহ বলা হয়ে থাকে।


৬. আসুরিক বিবাহ - কন্যা পিতাকে পণ বা যৌতুক প্রদান করে পাত্র যদি বিবাহ করে, তাকে অসুর বা আসুরিক বিবাহ বলে। অনেক সময় পাত্র আকৃষ্ট থাকলে মেয়েটির প্রতি তখন কোনো আত্মীয়কে নানা প্রলোভন দেখিয়ে বা ভুলিয়েও এই প্রকার বিবাহ করে থাকে। এই প্রকার বিবাহ বর্তমানেও বহু হয়ে থাকে কিন্তু তা বুঝতে বা জানতে পারা যায় না।
৭.  বৈশাখ বিবাহ - কন্যাকে অচেতন করে বা মানসিক ভাবে অসুস্থ করে, গোপনে তাকে বিবাহ করা হলে তাকে পৈশাচিক বিবাহ বলা হয়। এক্ষেত্রে দুজন প্রথমে প্রেম করবে, তারপর সুযোগ বুঝে গোপনে নারীকে মাদকদ্রব্য খাইয়ে অর্ধজ্ঞানহীন করে যৌনমিলন করা হয়ে থাকে। এরপর পুরোহিত ডেকে সেই নারীকে বিবাহ করা হয়। এক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময়ই নারীকে বাধ্য হয়ে বিবাহ করতে হয়। এ বিবাহ প্রথা সাধারণত বাৎসায়নের যুগে ছিল।
৮.  রাক্ষস বিবাহ - কন্যার পিতাকে আহত বা হত করে, কন্যাকে বলপূর্বক হরণ করে বিবাহ করাকে রাক্ষস বিবাহ বলা হয়। এক্ষেত্রে কোনো রূপসী নারীকে লাভ করা দুষ্কর হলে, তাকে পুরাকালে ক্ষত্রিয় রাজারা এইভাবে বাহুবলে ধরে এনে বিবাহ করত। বর্তমানে এর প্রচলন নেই বললেই চলে।


এছাড়া বেদে আরও দু ধরনের বিবাহের কথা বলা আছে যা হল -
ক. অনুলোম বিবাহ - কোনো উচ্চবর্ণের পুরুষ যদি নিম্নবর্ণের কোনো নারীকে বিবাহ করে, তখন তাকে অনুরোধ বিবাহ বলা হত।
খ. প্রতিলোম বিবাহ - সমাজের উচ্চবর্ণের নারী যখন কোনো নিম্নবর্ণের পুরুষকে বিবাহ করত, তখন তাকে প্রতিলোম বিবাহ বলা হয়ে থাকে।
যদিও তৎকালীন সময়ে ধর্ম অনুযায়ী এই অনুলোম ও প্রতিলোম বিবাহ সমাজে স্বীকৃত ছিল না।
বিবাহের এই একাধিক পদ্ধতি দেখা গেলেও বর্তমানের আধুনিক সমাজে প্রজাপত্য বিবাহের প্রচলনই দেখা যায়। সমাজে উন্নতির সাথে সাথে অন্যান্য বিবাহ প্রথার বিনাশ ঘটলেও একেবারে বিলুপ্ত সাধন যে ঘটেনি, তা আজকাল খবরের কাগজে 'বলপূর্বক বিবাহ', 'পণ দ্বারা বিবাহ' ইত্যাদি খবর থেকেই বোঝা যায়। তবে আশা করা যায় পরবর্তী শতকে সমাজের মানসিকতার উন্নতি সাধন ঘটলে এ ধরনের অসামাজিক বিবাহ পদ্ধতির সম্পূর্ণরূপে সমাপ্তি ঘটবে।
 তথ্যসূত্র-
১. বাংলাপিডিয়া।
২. উইকিপিডিয়া।

Tuesday, June 2, 2020

সাগরসঙ্গমে 'সন্তান বিসর্জন' - অর্পণা পাল

নবম শ্রেণীর পাঠ্য বইতে পড়তে গিয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের 'সাগরসঙ্গমে'র মধ্যেই প্রথমবার 'গঙ্গায় সন্তান বিসর্জন' এর ঘটনার কিছুমাত্র আভাস পেয়েছিলাম। বিষয়টি তখন অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল। কারণ, কোন মা তার সন্তানকে সাগরের জলে বিসর্জন দিতে পারে এই ঘটনাটাই ছিল আমার স্বপ্নাতীত! তখন জানতাম না, কুসংস্কারাচ্ছন্ন এই দেশে ধর্মের নামে কত অনাচার হয়ে থাকে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সারা পৃথিবীতে ধর্মীয় কুসংস্কারের বলি হয়ে এসেছে সহস্ত্র নিরাপরাধ প্রাণ। এই ধর্মীয় কারণে নরবলি, সতীদাহ সহ শিশুহত্যার অন্যতম একটি জঘন্য প্রথা ছিল এই 'গঙ্গায় সন্তান বিসর্জন'।

 প্রাচীনকাল থেকেই ধর্মীয় আচার আচরণে ভারতে নানা 'দান' এর কথা উল্লেখযোগ্য। অগ্নিতে, জলে, অনশনের দ্বারা ধর্মমূলক ব্রত পালনের মাধ্যমে অনেকেই আত্মদান করেছেন। তাদের মধ্যে নিজের সন্তানকে গঙ্গা বা অন্য কোনো পবিত্র নদীতে বা সাগরে উৎসর্গ করা 'দান' এর আরো একটি নৃশংস অধ্যায়। ভারতের উড়িষ্যা ও পূর্ব বাংলায় এই প্রথা প্রচলিত ছিল। যতদূর জানা যায়, স্ত্রীলোক বিবাহের পর অনেকদিন অপুত্রক থাকলে বা মৃত সন্তান প্রসব করলে স্বামী-স্ত্রী উভয়ই মানসিক করত যে, প্রথম সন্তানকে তারা গঙ্গায় উৎসর্গ করবে। এরপর সন্তান জন্ম হলে তিন-চার বছর বয়সে একটি শুভ দিন ঠিক করে তাকে গঙ্গায় স্রোতে ভাসিয়ে দেওয়া হত। যদি নিজে থেকে শিশুটি ভেসে না যেত তবে বাবা-মা তাকে জলে ঠেলে অথবা ছুড়ে ফেলে দিত। গঙ্গাসাগরে এরূপ অনেক 'সন্তান বিসর্জন' দেওয়ার ঘটনা দেখা যেত।
Hugh Murray এক লেখায় বলেছিলেন, অনেকে ৩,৪ বছরের সন্তানকে জলে ভাসিয়ে দিত বা নিক্ষেপ করত এবং অন্য দয়াবান ব্যক্তিরা কখনো কখনো শিশুটিকে নিয়ে যেত। তিনি পরিসংখ্যান দেখে জানিয়েছিলেন দু'বছরে প্রায় 500 টি শিশু বিসর্জন দেওয়া হত। সময় সময় শিশুকে জলের কাছ থেকে কুমীরে টেনে নিয়ে যাবে এই অভিপ্রায় রাখা হয়ে থাকতো বলে জানা যায়।

 ঊনবিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশদের চেষ্টায় দেশের অনেক কুপ্রথার নিবারণ ঘটে তার মধ্যেও এটি একটি উল্লেখযোগ্য। এই 'সন্তান বিসর্জন' বিষয়ে উইলিয়াম কেরি তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়েলেসলিকে একটি প্রতিবেদনে জানান, বঙ্গোপসাগরের উপকূলে যে স্থান গঙ্গাসাগর নামে পরিচিত, সেখানে নভেম্বর থেকে জানুয়ারি মাসের মধ্যে বহু পূর্ণার্থী আসেন। বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, বেনারস ও উত্তর ভারতের বিভিন্ন তীর্থযাত্রীদের সাথে একদল মহিলা সেখানে আসেন শিশুসন্তানকে উৎসর্গ করতে। তারা তাদের জ্যান্ত শিশুকে জলে ঠেলে ফেলে দেন। এতে নাকি গঙ্গাদেবী সন্তুষ্ট হন। এমন নিষ্ঠুর, বীভৎস  শিশুহত্যা যারা করে থাকে তারা মানবিকতার বা মানবতার বিরুদ্ধে চরম অপরাধী। লর্ড ওয়েলেসলি এই প্রতিবেদন পড়েন এবং এরপর ১৮০১ সালে সেপাই - সান্ত্রী নিয়ে পৌছে যান সেখানে এবং নানা কঠোর আইনিভাবে পদক্ষেপ নেন। পরবর্তীকালে ১৮০২ সালের ২০ আগস্ট কাউন্সিল থেকে জারি করা হয় রেগুলেশন - ৬। যাতে বলা হয়, যদি কোন ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত শিশুকে সাগর, গঙ্গা বা জলাশয়ে নিক্ষেপ করে হত্যা চেষ্টা করে তাহলে সেই ব্যক্তিকেও প্রাণদন্ডে দন্ডিত করা হবে।

গবেষকদের মতে, হিন্দু সমাজের ধর্মীয় কুসংস্কারের বিষয়ে প্রথম হস্তক্ষেপ করেছিল ইংরেজ প্রশাসন। এর মূলে ছিল উইলিয়াম কেরির নেতৃত্বে একদল মহানুভব মিশনারী। অবশ্য অনেকেই বলেন, এই ধর্মযাজকদের উদ্দেশ্য ছিল হিন্দুধর্মের কুসংস্কার গুলিকে তুলে ধরে হিন্দুদের খ্রিস্টধর্মের স্থানান্তরিত করা। তবে বিতর্ক ছিল, তা চিরকাল থাকবে.. কিন্তু এই প্রথার অবসান ঘটেছে এক্ষেত্রে উইলিয়াম কেরির ভূমিকা কোনদিন ভোলার নয়। যদিও আজও গঙ্গাসাগরে কাতারে কাতারে পূর্ণার্থীর ভিড় দেখা যায় কিন্তু বর্তমানে এই বিসর্জন প্রক্রিয়ার সম্পূর্ণরূপেই বিলুপ্তি ঘটেছে। তবুও সাগরসঙ্গমে বা গঙ্গানদীর বিভিন্ন প্রান্তে এখনো মাঘী পূর্ণিমায় মহিলাদের দেখা যায়, তারা তাদের শিশুসন্তানকে জলে ছুঁইয়ে কোলে তুলে নিচ্ছেন। তা অবশ্যই এই বিলুপ্ত প্রথার একটি প্রতীক মাত্র।
তথ্যসূত্র
১. প্রবাসী (আষাঢ় ১৩৩৩)
২. উইকিপিডিয়া
চিত্রঋণ
  উইকিপিডিয়া

Shilajit Resin

Shilajit Resin Tap into your full potential with India’s first clinically researched, purified shilajit resin, sourced from 18,000 feet of t...