নবম শ্রেণীর পাঠ্য বইতে পড়তে গিয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের 'সাগরসঙ্গমে'র মধ্যেই প্রথমবার 'গঙ্গায় সন্তান বিসর্জন' এর ঘটনার কিছুমাত্র আভাস পেয়েছিলাম। বিষয়টি তখন অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল। কারণ, কোন মা তার সন্তানকে সাগরের জলে বিসর্জন দিতে পারে এই ঘটনাটাই ছিল আমার স্বপ্নাতীত! তখন জানতাম না, কুসংস্কারাচ্ছন্ন এই দেশে ধর্মের নামে কত অনাচার হয়ে থাকে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সারা পৃথিবীতে ধর্মীয় কুসংস্কারের বলি হয়ে এসেছে সহস্ত্র নিরাপরাধ প্রাণ। এই ধর্মীয় কারণে নরবলি, সতীদাহ সহ শিশুহত্যার অন্যতম একটি জঘন্য প্রথা ছিল এই 'গঙ্গায় সন্তান বিসর্জন'।
প্রাচীনকাল থেকেই ধর্মীয় আচার আচরণে ভারতে নানা 'দান' এর কথা উল্লেখযোগ্য। অগ্নিতে, জলে, অনশনের দ্বারা ধর্মমূলক ব্রত পালনের মাধ্যমে অনেকেই আত্মদান করেছেন। তাদের মধ্যে নিজের সন্তানকে গঙ্গা বা অন্য কোনো পবিত্র নদীতে বা সাগরে উৎসর্গ করা 'দান' এর আরো একটি নৃশংস অধ্যায়। ভারতের উড়িষ্যা ও পূর্ব বাংলায় এই প্রথা প্রচলিত ছিল। যতদূর জানা যায়, স্ত্রীলোক বিবাহের পর অনেকদিন অপুত্রক থাকলে বা মৃত সন্তান প্রসব করলে স্বামী-স্ত্রী উভয়ই মানসিক করত যে, প্রথম সন্তানকে তারা গঙ্গায় উৎসর্গ করবে। এরপর সন্তান জন্ম হলে তিন-চার বছর বয়সে একটি শুভ দিন ঠিক করে তাকে গঙ্গায় স্রোতে ভাসিয়ে দেওয়া হত। যদি নিজে থেকে শিশুটি ভেসে না যেত তবে বাবা-মা তাকে জলে ঠেলে অথবা ছুড়ে ফেলে দিত। গঙ্গাসাগরে এরূপ অনেক 'সন্তান বিসর্জন' দেওয়ার ঘটনা দেখা যেত।
Hugh Murray এক লেখায় বলেছিলেন, অনেকে ৩,৪ বছরের সন্তানকে জলে ভাসিয়ে দিত বা নিক্ষেপ করত এবং অন্য দয়াবান ব্যক্তিরা কখনো কখনো শিশুটিকে নিয়ে যেত। তিনি পরিসংখ্যান দেখে জানিয়েছিলেন দু'বছরে প্রায় 500 টি শিশু বিসর্জন দেওয়া হত। সময় সময় শিশুকে জলের কাছ থেকে কুমীরে টেনে নিয়ে যাবে এই অভিপ্রায় রাখা হয়ে থাকতো বলে জানা যায়।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশদের চেষ্টায় দেশের অনেক কুপ্রথার নিবারণ ঘটে তার মধ্যেও এটি একটি উল্লেখযোগ্য। এই 'সন্তান বিসর্জন' বিষয়ে উইলিয়াম কেরি তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়েলেসলিকে একটি প্রতিবেদনে জানান, বঙ্গোপসাগরের উপকূলে যে স্থান গঙ্গাসাগর নামে পরিচিত, সেখানে নভেম্বর থেকে জানুয়ারি মাসের মধ্যে বহু পূর্ণার্থী আসেন। বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, বেনারস ও উত্তর ভারতের বিভিন্ন তীর্থযাত্রীদের সাথে একদল মহিলা সেখানে আসেন শিশুসন্তানকে উৎসর্গ করতে। তারা তাদের জ্যান্ত শিশুকে জলে ঠেলে ফেলে দেন। এতে নাকি গঙ্গাদেবী সন্তুষ্ট হন। এমন নিষ্ঠুর, বীভৎস শিশুহত্যা যারা করে থাকে তারা মানবিকতার বা মানবতার বিরুদ্ধে চরম অপরাধী। লর্ড ওয়েলেসলি এই প্রতিবেদন পড়েন এবং এরপর ১৮০১ সালে সেপাই - সান্ত্রী নিয়ে পৌছে যান সেখানে এবং নানা কঠোর আইনিভাবে পদক্ষেপ নেন। পরবর্তীকালে ১৮০২ সালের ২০ আগস্ট কাউন্সিল থেকে জারি করা হয় রেগুলেশন - ৬। যাতে বলা হয়, যদি কোন ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত শিশুকে সাগর, গঙ্গা বা জলাশয়ে নিক্ষেপ করে হত্যা চেষ্টা করে তাহলে সেই ব্যক্তিকেও প্রাণদন্ডে দন্ডিত করা হবে।
গবেষকদের মতে, হিন্দু সমাজের ধর্মীয় কুসংস্কারের বিষয়ে প্রথম হস্তক্ষেপ করেছিল ইংরেজ প্রশাসন। এর মূলে ছিল উইলিয়াম কেরির নেতৃত্বে একদল মহানুভব মিশনারী। অবশ্য অনেকেই বলেন, এই ধর্মযাজকদের উদ্দেশ্য ছিল হিন্দুধর্মের কুসংস্কার গুলিকে তুলে ধরে হিন্দুদের খ্রিস্টধর্মের স্থানান্তরিত করা। তবে বিতর্ক ছিল, তা চিরকাল থাকবে.. কিন্তু এই প্রথার অবসান ঘটেছে এক্ষেত্রে উইলিয়াম কেরির ভূমিকা কোনদিন ভোলার নয়। যদিও আজও গঙ্গাসাগরে কাতারে কাতারে পূর্ণার্থীর ভিড় দেখা যায় কিন্তু বর্তমানে এই বিসর্জন প্রক্রিয়ার সম্পূর্ণরূপেই বিলুপ্তি ঘটেছে। তবুও সাগরসঙ্গমে বা গঙ্গানদীর বিভিন্ন প্রান্তে এখনো মাঘী পূর্ণিমায় মহিলাদের দেখা যায়, তারা তাদের শিশুসন্তানকে জলে ছুঁইয়ে কোলে তুলে নিচ্ছেন। তা অবশ্যই এই বিলুপ্ত প্রথার একটি প্রতীক মাত্র।
তথ্যসূত্র১. প্রবাসী (আষাঢ় ১৩৩৩)
২. উইকিপিডিয়া
চিত্রঋণ
উইকিপিডিয়া
ভালো হয়েছে, আর একটু তথ্য দেওয়া গেলে সমৃদ্ধ হবে লেখাটি,
ReplyDelete🤗
ReplyDeleteসাগরসঙ্গমে নবকুমার
ReplyDeleteকোনো গল্প না। বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস কপালকুণ্ডলার অংশ।
লেখাটিতে তথ্য পরিবেশন বিভ্রান্তিকর।সাগরে সন্তান বিসর্জন যে জায়গাগুলিতে প্রচলিত ছিল বলা হয়েছে তার উল্লেখ দুটি অনুচ্ছেদে দু রকম।
আপাতত মৌলিকতা লেখাটিতে পাইনি।মনে হল দডেইলিহান্ট কপি করা অনেকাংশে।
রবীন্দ্রনাথের দেবতার গ্রাস এ ব্যাপারে উল্লেখ কিরা যেত। মহাভারতে গঙ্গাদেবি সাত সন্তানকে জন্মের পরপরই গঙ্গায় বিসর্জন দেন।সে কাহিনীও উল্লেখ করা যেত।অষ্টবসুর কাহিনী উল্লেখ করা যেত।
পরে আর বলার মত মনে একে জানাব।
উপদেশ দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। অবশ্যই জানাবেন।😊
ReplyDelete