Friday, May 29, 2020

পঙ্গপালের ইতিবৃত্ত - অর্পণা পাল

করোনা মহামারী - আমফান ঘূর্ণিঝড়ের পর এবার দেশে পঙ্গপাল বাহিনীর হানা! কিন্তু এই পঙ্গপাল আসলে কি?
                                ১. একটি প্রাপ্ত বয়স্ক পঙ্গপাল
'পঙ্গপাল' শব্দটা শুনে আমাদের প্রথমেই 'সহজ পাঠে'র একটি গল্পের কথা মনে পড়ে - 'পঙ্গপাল না তাড়াতে পারলে এবার কাজে ভঙ্গ দিতে হবে'। এছাড়া পঙ্গপালের ব্যাপারটা কিরূপ, সে সম্পর্কে আমাদের ধারণা অস্পষ্ট। তার প্রধান কারণ প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার অভাব‌। একসঙ্গে অগণিত পঙ্গপালের আক্রমণ যে কি ভয়াবহরূপ নিতে পারে তা হৃদয়ঙ্গম করা অসম্ভব। টিভির পর্দায় দেখে এই দৃশ্য আমরা ধারণা করতে পারি মাত্র, কিন্তু বাস্তব ঘটনার ভীষণতা উপলব্ধি করতে পারিনা।
                      ২. শহরাঞ্চলে পঙ্গপালের আক্রমণ
এই পঙ্গপাল মূলত একপ্রকার পতঙ্গ। সাধারণত এরা একাই থাকে। কিন্তু অনেক সময়ে এরা সংখ্যায় বেড়ে যায়। তখন তারা দল বেঁধে থাকে। আবার কখনও কখনও মস্তিষ্কে তৈরী হওয়া 'সেরোটোনিন' নামে নিউরোট্রান্সমিটারে এই পতঙ্গের স্বভাব বদলায়। তখন তারা ব্যাপক হারে প্রজনন করে ঝাঁকে ঝাঁকে অন্যত্র পাড়ি দেয়। 
এই পঙ্গপালের ইতিহাস বহু বছরের পুরোনো। প্রাচীন মিশরীয়দের কবরে এই পতঙ্গের ছবি দেখা যায়। এছাড়া প্রাচীন ধর্মগ্ৰন্থ ইলিয়াডেও এই পতঙ্গের উল্লেখ পাওয়া যায়। এছাড়া বাইবেলের মতো ধমগ্ৰন্থে এই পঙ্গপালের উল্লেখ পাওয়া গেছে। এখানে এই পতঙ্গকে ঈশ্বরের শাস্তিস্বরূপ প্রতিবিধান বলা হয়েছে।
                                   ৩. প্রাচীনকালে উল্লেখিত পঙ্গপালের চিত্র
  পঙ্গপালের আক্রমণ সৃষ্টির জন্য জলবায়ু পরিবর্তনকে দায়ী করা হয়। সাধারণত ঘূর্ণিঝড়ের কারণে পঙ্গপালেরা স্থানান্তরিত হয়ে থাকে। এরা কোনো গুল্ম জাতীয়, তৃণভূমি বা শস্য ক্ষেতের মধ্যে প্রবেশ করার পূর্বে ও পরবর্তী অবস্থার মধ্যে বিস্তর পরিবর্তন দেখা যায়। ছোট ঘাসলতার কথা তো ছেড়েই দেওয়া যাক, এরা বড় বৃক্ষকে পত্রহীন করে ফেলতে পারে। ফলে নিমেষের মধ্যেই সবুজ বিস্তীর্ণ ভূমিকে এরা মরুভূমির রূপ দিতে পারে। হঠাৎ করে দেখলে মনে হবে যাদুবলে কোন স্থানের পরিবর্তন হয়ে গেছে। এর থেকেই পঙ্গপালের শক্তির কিঞ্চিত ধারণা করা যায়। এই পঙ্গপালের আক্রমণ এর পরেই অনেক দুর্ভিক্ষ সৃষ্টির দৃষ্টান্ত পাওয়া গেছে, আবার অন্যদিকে এই পঙ্গপালকে মানুষ নিজের খাদ্য বানিয়েছে। যা বিশ্বের অনেক দেশেই লোভনীয় খাদ্য।
                                    ৪. খাদ্যরূপে পঙ্গপালের ব্যবহার
 এই বিজ্ঞানের যুগেও পঙ্গপালের উপদ্রবের প্রতিকারের তেমন কোনো কার্যকর পন্থা আবিষ্কৃত হয়নি। ১৯২৮ সালে প্যালেস্টাইন এই পঙ্গপালের আক্রমণে শশ্মান ভূমিতে পরিণত হয়েছিল। ১৯২৫ সালে মিশরে পঙ্গপালের আক্রমণ হয়েছিল যা কীটবিজ্ঞানীদের দ্বারা কিছুটা আয়ত্তে আনা সম্ভব হয়েছিল। এছাড়া আলজেরিয়া, পারস্য, দক্ষিণ আমেরিকা, দক্ষিণ আফ্রিকা ও রাশিয়ার বহু স্থানে বছরের পর বছর ধরে পঙ্গপালের উপদ্রব দেখা গেছে। গত ২৫ - ৩০ বছরের মধ্যে আমাদের দেশে এই পঙ্গপালের আক্রমণ তেমনভাবে ঘটেনি। তবে বর্তমানে রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, গুজরাটে এই পঙ্গপালের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে।
                                     ৫. শস্যক্ষেতে পঙ্গপালের আক্রমণ
 বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জমিতে কীটনাশক ছড়িয়ে, যন্ত্রের সাহায্যে, আগুনের হলকা ছুঁড়ে, জলাশয়ে ফাঁদ পেতে ধরা হয়েছে পঙ্গপালদের। ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে এর প্রকোপ কমেছে। কিন্তু কম হলেও তা আজও পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। তারই দৃষ্টান্ত স্বরূপ এই পঙ্গপালের  আক্রমণের একটি ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠতে চলেছে বর্তমানে আমাদের দেশে।
তথ্যসূত্র এবং চিএঋণ :-
উইকিপিডিয়া

Sunday, May 17, 2020

বর্তমানে বিপন্ন লোকসঙ্গীতের অস্তিত্ব - অর্পণা পাল

সংস্কৃতি সম্পূর্ণ বিশ্বের একটি অপরিহার্য অঙ্গ। পৃথিবীর প্রত্যেকটি দেশের নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে। সেইসব লোকজ উপাদানের গর্ভে জন্ম নেওয়া লোকসংস্কৃতি বর্তমানে প্রায় অবলুপ্ত আবার কোথাও কোথাও তাতে লেগেছে আধুনিকতার হাওয়া। এই তালিকায় বাংলার লোকসংস্কৃতি ও বাদ যায়নি। বিনোদনের নানাবিধ পসরার দৌরাত্ম্যে বাংলার চিরন্তন লোকসংস্কৃতি কি হারিয়ে যাচ্ছে?
   বাংলা লোকসংস্কৃতি একটি বিরাট অধ্যায়। মানবজীবনের প্রতিটি পরতে যে বিষয়গুলি পরম্পরায় আবহমানকাল ধরে টিকে রয়েছে তার সবকিছুই লোকসংস্কৃতির উপাদান। আর এই লোকসংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ হলো লোকসংগীত বা লোকগীতি। সংস্কৃতির উপর সংগীতের প্রভাব বিস্তর। মূলত এই সংস্কৃতি গুলি স্থাপন হয়েছিল আঠারো শতকে। গ্রাম-বাংলার লোকসংগীত এর মধ্যে বাউলগান, জারি, সারি, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, মুর্শিদী, গম্ভীরা, লেটোগান, কবিগান ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। গ্রামাঞ্চলের এই লোকসঙ্গীতের সাথে বাদ্যযন্ত্র হিসাবে মূলত একতারা, দোতারা, সারেঙ্গা, খোল, ঢোল, বাঁশী, খমক, মন্দিরা, কাঁসর, ঘণ্টা, মৃদঙ্গ, ডুগডুগি ইত্যাদি ব্যবহার করা হতো।
                  ১. গ্ৰামবাংলার লোকসঙ্গীতের আসর
বাংলার লোকসংগীতের মধ্যে বিভিন্ন ধারার গানের পরিচয় পাওয়া যায়। সেসব গান বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, কতক গান একক কণ্ঠে গীত হতো, আবার কতক সমবেত কণ্ঠে। এদের মধ্যে যেগুলি ব্যক্তিবিশেষ রচয়িতা সেগুলি হল -
১. বাউল গান - বাউল একটি সাধন-ভজন গোষ্ঠী যারা গ্রামে গঞ্জে ভিক্ষা করে বেড়ায়। এরা দেহভিত্তিক সাধনার অনুসারী। এই সাধনায় সুফি ভাবনার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। বাউলরা মন্দির-মসজিদে যায় না, কোন ধর্মগ্রন্থে তাদের বিশ্বাস নেই, মূর্তিপূজা, বর্ণবৈষম্য, জাতিভেদে তারা বিশ্বাসী নয়, তারা মানবতাবাদী। কেউ কোনোোদিন জন্ম থেকেই বাউল হতে পারে না, গুরুর নিকট দীক্ষা নিয়ে বাউল হতে হয়। এই সাধনা মূলত নারী-পুরুষ মিলিত যুগলসাধনা। তাদের এই সাধনার দর্শন ও মতামতকে তারা গানের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করে থাকে। বাউল মত সতেরো শতকে জন্ম নিলেও লালন সাঁই এর মাধ্যমেই বাউল গান উনিশ শতক থেকে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তিনি শ্রেষ্ঠ বাউল গান রচয়িতা ছিলেন। তিনি প্রায় দু'হাজারের মতো গান বেঁধেছিলেন। রবীন্দ্রনাথও বাউল গান দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। যা পরবর্তীকালে 'তোরা যে যা বলিস ভাই আমার সোনার হরিণ চাই', 'যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে', 'গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙ্গামাটির পথ', 'পাগলা হাওয়ায় বাদল দিনে' ইত্যাদি গানের মধ্য দিয়ে লক্ষ্য করা যায়। যা আজও অত্যন্ত জনপ্রিয়।
                       ২.গ্ৰামের বাউল গান
২. ভাটিয়ালি - বাংলার লোকসংগীতে ভাটিয়ালি ভাটি অঞ্চলের অত্যন্ত জনপ্রিয় সংগীত। যা বিশেষ করে নদ-নদী পূর্ণ বাংলাদেশের কিছু কিছু অঞ্চলে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। এই গানগুলো মূলত প্রকৃতিতত্ত্বের গান। এই গানের মূল বৈশিষ্ট্য এগুলি রচিত হয় মূলত মাঝি, নৌকো, দাঁড় ইত্যাদি বিষয়ে। সাথে থাকে গ্রামীণ জীবন, গ্রাম্য নারীর প্রেম, বিরহ, আকুলতা ইত্যাদি। এই ভাটিয়ালি গান এই দেশের প্রানের চেতনা থেকে উৎসারিত। যেহেতু গানগুলি অপটু হাতে রচিত তাই গানগুলি গুণগত মান উন্নত না হলেও গ্রাম্য জীবনে এই গানের প্রচলন ছিল অত্যধিক। নদীর স্রোতের টানে নৌকো নিয়ে যাওয়ার সময় এই গানগুলো গাওয়া হতো। কিন্তু বর্তমান যুগে এই ভাটিয়ালি গানকে এমনভাবে চোখে ধরা পড়তে দেখা যায় না। এই ভাটিয়ালি গানের অন্যতম রচয়িতা হলেন রশিদ উদ্দিন, জালাল খাঁ, কবি নিবারণ পণ্ডিত।
                     ৩.ভাটি অঞ্চলের ভাটিয়ালি গান
৩. মুর্শিদি - এই মুর্শিদি গান এক প্রকার আধ্যাত্বিক লোকসংগীত। সুফিদের দ্বারা এর উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছে। 'মুর্শিদি' শব্দটি আরবি, এর শব্দমূল 'এরশাদ', অর্থ হলো আদেশ উপদেশ দেওয়া। যিনি ভক্তকে আদেশ উপদেশ দেন এবং তাকে আধ্যাত্মিক পথে পরিচালিত করে তাকে বলে মুর্শিদি। এই মুর্শিদিকে সরাসরি সম্মোধন করে ভক্ত আত্মনিবেদন করে থাকে গানের মাধ্যমে। ভক্ত আপনভাবে বিভোর হয়ে যে গান গায়, তার সেই গানের মধ্য দিয়েই প্রকাশিত হয় তার দুঃখ বেদনার কথা প্রার্থনার আকুলতা সেই গানকে মুর্শিদি গান বলা হয়। মুর্শিদের গুনগান ছাড়া এতে নৌকো, পাখি, রাধাকৃষ্ণের প্রেম ইত্যাদি বর্ণনা করা হয়। অন্য কোনো জটিল তত্ব নেই এই গানে। এখানেই এই গান স্বতন্ত্র। বর্তমানে বাংলাদেশে আজও এই গানের অস্তিত্ব রয়েছে। কয়েকটি বিখ্যাত মুর্শিদি গান হল - 'দয়াল আমার কান্ডারী হইও রে' অথবা 'তুমি দাও দেখা দরদী রে আমায়'।
                 ৪. সুফিদের দ্বারা প্রস্তুত মু‌শিদি গান
৪. ভাওয়াইয়া - এই গান দিয়ে মূলত মনের ভাব প্রকাশ করা হত। এই গান পশ্চিমবঙ্গের উত্তরের পার্বত্য অঞ্চলে এবং আসামের পার্বত্য  অঞ্চলে, বাংলাদেশের রংপুর অঞ্চলের গোয়ালপাড়ার মধ্যে প্রচলিত ছিল। এই ভাওয়াইয়ার মূল বৈশিষ্ট্য, এই গানগুলিতে পারিবারিক স্মৃতির ছবি, বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দৃশ্যপট, জনজীবনের জীবনযাত্রা, কর্মজীবন ইত্যাদি ছবি ফুটে উঠত। বাংলার উত্তরাঞ্চলের নদ-নদী কম থাকায় সেখানে রাস্তায় গরুর গাড়ি দ্বারা চলাচল করতে হতো। এই গরুর গাড়ির গাড়োয়ান  গাড়ী চলা অবস্থায় আপন ভাবাবেগে কাতর হয়ে গান করত। উঁচু নিচু রাস্তায় গরুরগাড়ির চাকা পড়লে তার গানের সুরের মধ্যেও ভাঁজ পড়ত। এই সুরে ভাঁজ পড়ার রীতি ভাওয়াইয়া গানের এক লক্ষণীয় বিষয় যা এই গানকে অন্যান্য লোকসংগীত এর মধ্যে পৃথক করেছে। কবি আব্বাসউদ্দিনকে এই 'ভাওয়াইয়া গানের সম্রাট' বলা হয়।
                     ৫. বাংলার ভাওয়াইয়া গান
উপরিউক্ত সমস্ত প্রকার গানগুলি একক কণ্ঠে গাওয়া হতো, তা থেকেই গানগুলি রচিত হত। কিন্তু লোকসঙ্গীতের বিরাট একটি অংশের গান গাওয়া হতো সমবেত ভাবে অথবা কখনো কখনো নৃত্য নাটকের সাথে এই জাতীয় সংগীতগুলি পরিবেশন করা হত। সেগুলি হল -
১. কবিগান - কবিগান বাংলার লোকসংস্কৃতির একটি বিশেষ ধারা। মধ্য যুগে এই কবিগানের উদ্ভব হলেও ১৭৬০ থেকে ১৮৩৭ সালের মধ্যবর্তী সময়ে এই কবিগানের প্রকৃত বিকাশ ঘটে। এই ধারায় প্রতিযোগিতামূলক গানের আসরে অংশগ্রহণ করে থাকেন। যিনি গায়ক হন তিনি মুখে মুখে পদ রচনা করেন এবং তাৎক্ষণিকভাবে সুরারোপ করে থাকেন। এই গায়ককেই কবিয়াল বলা হয়। কবিয়ালের সহকারি গায়ককে দোহার বলে। এই প্রতিযোগিতায় কবিয়াল মুখে মুখে গান বেঁধে অপর পক্ষের কবিয়ালকে আক্রমণ করেন এবং তিনিও গানের মাধ্যমেই সেই আক্রমনের প্রতি উত্তর দেন।
আজ অবধি প্রায় একশ'র বেশি কবিয়াল কবিগানের বিকাশে অবদান রেখেছেন। তাদের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন হলেন গোজলা গুঁই, রাম বসু, ভবানী, ভোলা ময়রা, নিধুবাবু, মুকুল দত্ত, বিজয় সরকার প্রমুখ। এছাড়া, একজন পর্তুগিজ বণিকও বাংলার নামজাদা কবিয়াল হয়েছিলেন। তিনি হলেন অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি। এই অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির একটি বিখ্যাত পংক্তি যা তিনি ভোলা ময়রাকে গানের জবাব দিয়েছিলেন -
 "খ্রিস্ট আর কৃষ্ণে কিছু প্রভেদ নাই রে ভাই
 শুধু নামের ঘোরে মানুষ ফেরে, 
  এত কথা শুনি নাই।"
কিন্তু পরবর্তীকালে এই কবিগানের অবনমন ঘটে। এটি রূচিহীনদের সময় কাটানোর অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়ায় এবং জমিদারি  প্রথার অবসানের সঙ্গে সঙ্গে এই কবিগানের ঐতিহ্যও ধীরে ধীরে মুছে যায়।
                     ৬. বাংলার কবিগানের আসর
২. জারি গান - জারি গান বাংলার এক ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীতরীতি। ফরাসিতে 'জারি' শব্দের অর্থ শোক। সতেরোশো শতক থেকে বাংলায় এই গানের ধারা শুরু হয়। ইসলামের ইতিহাসভিত্তিক নাট্যধারায় এই জারিগান সর্বাধিক জনপ্রিয়। মহরমের মাসে কারবালার দুঃখজনক কাহিনীর দ্বারাই এই গানের উদ্ভব ঘটেছিল। কারবালার যুদ্ধের অন্তর্গত বেদনার কথাই এক ধরনের  সুর, নৃত্য দ্বারা এই গানের পরিবেশিত হতো। এছাড়াও যেকোন ধর্মীয় ও সামাজিক বিষয় নিয়েও কখনো কখনো জারিগান রচিত হত। কোথাও কোথাও আবার কবিগানের এক ভিন্ন রূপকেও জারি গান বলা হয়।একসময় সমগ্র বাংলায় এই গানের প্রচলন ছিল এমনকি শান্তিনিকেতনে এই জারি গান অনুষ্ঠিত হতো। কিন্তু বর্তমানে এই ধরনের নাট্য পরিবেশনার প্রচলন পূর্বের ধারাবাহিকতা চেয়ে কিছুটা কমে গেলেও একেবারে অবলুপ্তি ঘটেনি।
             ৭. মহরমের সময় পরিবেশিত জারিগান
৩. সারি গান - সারিগান বাংলার লোকসংগীত গুলির মধ্যে অন্যতম। সারিগান মূলত মাঝিরা গাইলেও অনন্য শ্রমজীবীদের মধ্যেও তার প্রচলন ছিল। নৌকার মাঝিরা একে অপরকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য এই ধরনের গান গাইত। নৌকাবাইচের সময় প্রতিটি নৌকার যে প্রধান মাঝি থাকে, তিনি এই গানের মূলপদটি গাইতেন। অন্যান্য মাঝিরা তার সাথে সুর দিতেন দলবদ্ধভাবে। তবে প্রত্যেকেই নৌকার গতি ও তাল মিলিয়ে গান গেয়ে ও সুর দিয়ে যান। প্রাচীনকাল থেকেই যেসব উৎসব পালন হয় তাদের মধ্যে অন্যতম হলো নৌকাবাইচ উৎসব। বর্ষাকালে উৎসবের সময় এই গান ছিল এই উৎসবের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
   ৮. নৌকোবাইচের সময় গীত সারিগান
৪. গম্ভীরা - লোকসঙ্গীতের এক প্রাচীন ধারা হলো 'গম্ভীরা'। এই গম্ভীরার উৎপত্তি হয়েছে মূলত মালদহ জেলায় কিন্তু তৎকালীন সমগ্র বাংলা জুড়েই ছিল এর বিস্তৃতি। এই গম্ভীরা শব্দের অর্থ হলো শিবের মন্দির বা গাজন ঘর। শিবের এক নাম হলো গম্ভীর। একসময় এই শিবের পুজোয় বন্দনা করে যে গান গাওয়া হতো তাকে বলে গম্ভীরা। এই গম্ভীরা একত্রে দলবদ্ধভাবে গাওয়া হত। মধ্যযুগের সনাতনধর্মীদের প্রধান পূজ্যো দেবতা  ছিলেন মহাদেব। তাই এই শিব পূজোকে ঘিরে প্রায় সারা বছর ধরেই নানা উৎসব পালন করা হতো। তখন পালা-অভিনয় ও গম্ভীরা গানের মাধ্যমে সমাজের সমস্যা গুলি তুলে ধরা হতো। বর্তমানে চৈত্রসংক্রান্তিতে বাংলার গ্রামীণ অঞ্চলের উৎসবে এই পালা-গম্ভীরা পরিবেশনা হয়ে থাকে। এই গম্ভীরার উল্লেখযোগ্য শিল্পী হল রকিবউদ্দিন, বীরেন ঘোষ প্রমূখ।
                      ৯. উৎসবে অনুষ্ঠিত গম্ভীরা
এই  একক কণ্ঠে গীত এবং সম্মিলিত কণ্ঠে গীত গান ছাড়াও গ্ৰামবাংলায় কিছু আঞ্চলিক লোকসংগীত এর অস্তিত্ব পাওয়া যায়। যেমন, পাহাড়ি অঞ্চলে ঝুমচাষ করার সময় তারা এক প্রকার সংগীত করত। লালমাটি অঞ্চলে ভাদু উৎসব, টুসু উৎসবেও একপ্রকার পাঁচালী গীত গাওয়া হতো। এছাড়া আধিবাসীদের উৎসবের সময় তারা প্রাচীন লোকসংগীত দ্বারা নৃত্য পরিবেশন করত। সেইসব সুরও বাংলার লোকসংগীতকে প্রভাবিত করেছে।
 কয়েকশো শতকের ঐতিহ্য ধারণকারী বাংলার লোকসংস্কৃতির সবচেয়ে জনপ্রিয় শাখা হলো লোকসংগীত। ঐতিহাসিক কাল থেকেই বাংলার মানুষ সঙ্গীতপ্রিয়। তাই প্রাচীনকালে এই লোকগীতি মানুষের সেই সঙ্গীত পিপাসু হৃদয়কে শান্ত করে এসেছে, একসময় এই লোকগীতি বেতারের মাধ্যমে প্রচার হতো যা শুনে গ্রামের সাধারণ মানুষ থেকে শহরের মধ্যবিত্ত মানুষ সবাই আনন্দ পেয়েছে। কিন্তু বর্তমানে লোকগীতির আসর খুবই কম দেখা যায়। বরং এই বিশ্বায়নের যুগে আমাদের সংগীত বাইরের দেশের সংগীত দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে। তাই আমাদের উচিত নিজেদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বজায় রেখে লোকসংস্কৃতি পুনরায় উজ্জীবিত করা। মনে রাখা প্রয়োজন আমাদের সমাজের শিকড় এই লোকসংস্কৃতি। তাই সমাজকে সজীব রাখতে শিকড়ের প্রতি যত্ন নেওয়া আমাদের দায়িত্ব।
তথ্যসূত্র -

  • বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস -  অসিত কুমার বন্দোপাধ্যায়
  • বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস - দেবেশ কুমার আচার্য
  • উইকিপিডিয়া
  • বাংলাপিডিয়া
চিত্রঋন -

  • উইকিপিডিয়া  

Monday, May 11, 2020

বিবর্তনের পথে শাড়ি - অপর্ণা পাল

'শাড়ি' বাঙালির পরিচয়ের সাথে মিশে আছে যা এই বাংলার অহংকার। সম্ভবত ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাচীনতম বস্ত্র এই শাড়ি, যার জনপ্রিয়তা আজও আকাশছোঁয়া। এই শাড়ির আবির্ভাব বাংলায় ঠিক কিভাবে ঘটেছিল তা জানা যায় না। তবে এই আবহমানকাল ধরে বাংলার শাড়ির স্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যুগে যুগে এই শাড়ির পাড়-আঁচল, ধরণ, বোনার ব্যবস্থা ও পরিধানের আদব-কায়দা পরিবর্তন হয়েছে।

                    ১. প্রাচীনকালের গ্রামবাংলায় শাড়ি পরিধান
এই শাড়ি শব্দের উৎপত্তি সংস্কৃতি 'শাটী' শব্দ থেকে। 'শাটী' শব্দের অর্থ পরিধানের বস্ত্র। ইতিহাসবিদ রমেশ চন্দ্র মজুমদার প্রাচীনকালের পোশাক সম্পর্কে বলেছিলেন, মেয়েরা পায়েের গোছা পর্যন্ত শাড়িি পরতো এবং আধখানা কাপড় উপরে জড়ানো থাকতো। পাল আমলের কিছু ভাস্কর্য থেকে তার অনুমান পাওয়া যায়। তৎকালে সেলাই করা বস্ত্রের রেওয়াজ ছিল না।একটুকরো কাপড়কে পুরুষরা 'ধুতি' এবং মেয়েরা 'শাড়ি' নামে অভিহিত করেছিল। গুপ্তযুগের কিছু নিদর্শনের মধ্যেও শাড়ির অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এছাড়া অজন্তা ইলোরা তেও শাড়ির প্রমাণ পাওয়া যায়।
                      ২. প্রাচীন যুগের শাড়ি পরিধানের নিদর্শন
                                              চিত্রঋন - উইকিপিডিয়া
 পরবর্তীকালে, দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতেও শাড়ি পরিধানের প্রচলন দেখা যায়। মুঘল যুগেও ধীরে ধীরে ভারতীয় সংস্কৃতি অনুযায়ী 'শাড়ি'র প্রচলন শুরু হয় কিন্তু তাতে কিছু মোগলাই সংযোজন ঘটে। এই মসলিন শাড়ির উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।
                       ৩. মুঘলযুগে মসলিন শাড়ির পরিধান
 এরপর ব্রিটিশদের সংস্পর্শে এসে শাড়ির গুণগতমান তার বুননের কৌশল সর্বোপরি শাড়ি পরিধানের প্রাচীন পদ্ধতির পরিবর্তন দেখা যায়। বাঙালির চিরাচরিত একপ্যাঁচে শাড়ি পরার ধারণাকে সম্পূর্ণ পাল্টে দেয়, ব্রিটিশ আদব-কায়দা ধীরে ধীরে গ্রহণ করে নেয় নারীসমাজ।
                   ৪. ব্রিটিশ আমলের শাড়ি পরিধানের নতুন ধরন
                                             চিত্রঋণ -উইকিপিডিয়া
 এক্ষেত্রে বাংলায় প্রথমে এই চলন শুরু হয় ঠাকুরবড়ি থেকেই। রবীন্দ্রনাথের মেজো ভাই সত্যেন্দ্রনাথের স্ত্রী ছিলেন জ্ঞানদানন্দিনী দেবী। তিনি প্রথম এই নিয়মে শাড়ি পরতে চাননি। স্বামীর সাথে তিনি ইউরোপের বলয়ের মধ্যে পড়ে তিনি ইংরেজি আদবকায়দা রপ্ত করেছিলেন। এছাড়া তিনি পারসি নারীদের শাড়ি পরার ধরন থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে নতুন করে শাড়ি পরতে শুরু করেন। ধীরে ধীরে তার এই শাড়ি পড়ার ধরণ ব্রাহ্ম সমাজের নারীদের মধ্যে প্রতিফলিত হয়। তারপর এই শাড়ি পড়ার ধরণের নাম হয় 'ব্রহ্মিকা শাড়ি'। এরপর ধীরে ধীরে পুরো ভারতীয় উপমহাদেশের নারীরা তা অনুসরণ করে।
                ৫. জ্ঞানদানন্দিনীর  পাশ্চাত্যের অনুকরনের শাড়ি পরিধান
                                              চিত্রঋণ - উইকিপিডিয়া 
 এরপর উনবিংশ শতকে শাড়ির সুতোর পরিবর্তন হয়। নতুন ধরনের আদব-কায়দা তে সমাজের বিবর্তন ঘটে। সাজপোশাকের নতুন ফ্যাশন শুরু হয়। সুতির পাশাপাশি সিল্কের জনপ্রিয়তা দেখা যায়। এছাড়া মসলিন, জামদানি, জর্জেট, কাতান, সিফন, বেনারসি ইত্যাদির প্রচলন দেখা যায়। যদিও বর্তমানে অন্যান্য যাতায়াতের সুবিধাজনক কিছু পোশাকের উদ্ভবের কারণে নিত্য পরিধানের বস্তু থেকে শাড়ির চাহিদা কিছুটা কমে গেছে। তবুও উৎসবের মরসুমে আধুনিক তারুণ্যের দল আজও বেছে নেয় তাদের চিরাচরিত পোশাক সেই শাড়িকেই।
                     ৬. বর্তমানে উৎসবের মৌসুমে শাড়ির পরিধান
তথ্যসূত্র:- 
১. বাংলা সাহিত্যের পোশাকের ইতিহাস - সুকুমার সেন
২. সাজমহল - জয়িতা দাস।
৩. উইকিপিডিয়া

Thursday, May 7, 2020

অচেনা রবি

আজ ভারতের প্রথম নোবেলজয়ী সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫৯ তম জন্মবার্ষিকী। গোটা বিশ্বের কাছে তিনি পরিচিত 'গুরুদেব' নামে। জন্ম-বার্ষিকী উপলক্ষে তার বিষয়ে কিছু অজানা তথ্য জেনে নিয়ে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করা যাক।


  • আমাদের জাতীয় সংগীত রবীন্দ্রনাথের রচনা। অনেকেই হয়তো জানেন না রবীন্দ্রনাথ শুধু এই দেশের জন্য নয়, আরও দুটি দেশের জন্য জাতীয় সংগীত রচনা করেছিলেন। যার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। তার জাতীয় সংগীত 'আমার সোনার বাংলা'। তবে শ্রীলঙ্কার জাতীয় সংগীত ও যে রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে নেওয়া তা হয়তো অনেকেই জানেন না। শ্রীলংকার খ্যাতিমান সংগীতশিল্পী আনন্দ সামারাকুন ১৯৩০ সালে বিশ্বভারতী চারুকলা ও সঙ্গীত বিষয়ে উচ্চশিক্ষা নিতে আসেন। সেখানে তিনি রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্য পান রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রিয় ছাত্র আনন্দ সামারাকুন এর জন্য বাংলা ভাষায় 'নমো নমো শ্রীলঙ্কা মাতা' গানটি রচনা করেন এবং সুর দেন। পরবর্তীকালে তিনি ১৯৪০ সালে শ্রীলংকার ফিরে যান এবং সিংহলি ভাষায় অনুবাদ করেন গানটি যার প্রথম লাইন 'নমো নমো মাতা আপা শ্রীলঙ্কা নমো নমো মাতা, সুন্দর শ্রী বরণী'। ১৯৫১ সালে গানটিকে শ্রীলঙ্কার জাতীয় সংগীত হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

১. শ্রীলঙ্কায় কবিশ্রদ্ধা জানিয়ে ছাপা ডাকটিকিট
  • রবীন্দ্রনাথের সাথে গান্ধীজীর একটি বিশেষ সম্পর্ক ছিল তা অনেকেই জানেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যে গান্ধীজিকে 'মহাত্মা' নামটি দেন তা অনেকেই জানেন না। এছাড়া, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং অ্যালবার্ট আইনস্টাইন এর মধ্যে এক নিবিড় সম্পর্ক ছিল। ১৯৩০-৩১ সালের মধ্যে এই দুই মহান ব্যক্তিত্ব চারবার সাক্ষাৎ করেন। তারা শুধু একে অপরকে সম্মান করতেন শুধু তাই নয় বিভিন্ন ধরনের বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন। যেমন হলো, তৎকালীন বিশ্বের পরিস্থিতি, সংস্কৃতি, সাহিত্য, বিজ্ঞান ও রাজনীতি। তবে, মুখোমুখি সাক্ষাৎ ছাড়াও দুজনের মধ্যে পত্র বিনিময় হয়েছে। রবীন্দ্রনাথকে জার্মান ভাষায় স্বহস্তে লেখা আইনস্টাইনের দুটি চিঠি শান্তিনিকেতনের সংগ্রহশালায় সুরক্ষিত রয়েছে।

                   
                                ২. রবীন্দ্রনাথ ও আইনস্টাইন এর সাক্ষাৎকার
                                                 চিএঋন - Wikipedia
              
                       ৩. গান্ধীজী ও রবীন্দ্রনাথ এর সাক্ষাৎকার
                                              চিএঋন - Wikipedia  
  • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুধু সাহিত্যিক হিসেবেই নয় একজন সঙ্গীতকার, নাট্যপরিচালক ও নাট্যকার হিসেবেও যথেষ্ট প্রসিদ্ধ ছিল। তিনি ২ হাজারের বেশি গান লিখেছেন ও সুর দিয়েছেন। যার অধিকাংশই তার ভ্রমণ থেকে অনুপ্রাণিত। রবি ঠাকুর দেশীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের পাশাপাশি ইংরেজি এবং স্কটিশ গান শুনতে পছন্দ করতেন। এছাড়া তিনি একাধিক নাটক পরিচালনা করেছেন ঠাকুরবাড়িতে। আবার কখনও কখনও তিনি নাটকে অভিনয় করেছেন যা দর্শক মহলে অত্যন্ত জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল।
                  
                          ৪. নাট্য অভিনেতা রূপে রবীন্দ্রনাথ
                               চিএঋন - Wikipedia
  • রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের কোন কিছুতেই একঘেয়েমি পছন্দ করতেন না। তাই তিনি বারবার বাড়ি বদল করতেন। শান্তিনিকেতনের উত্তরায়ণ তার এই স্মৃতিতেই ধন্য হয়েছিল। কোণার্ক - শ্যামলী - পুনশ্চ - উদয়ন - উদীচী এই পাঁচটি বাড়ি মিলিয়ে এই গড়ে উঠেছিল উত্তরায়ণ.. তা অনেকে জানলেও কি করে এতগুলি বাড়ির সৃষ্টি হয়েছিল তার তথ্য সকলের জানা নয়। এবারে আমরা তা জেনে নেব - 
১৯২৯ সালে শিলং থেকে শান্তিনিকেতনে এসে রবীন্দ্রনাথ বসবাস শুরু করেন উত্তরায়ন চত্বরে। তাই আগেই ১৯২৮ সালে তার প্রথম বাড়ি কোণার্কের কাজ সম্পূর্ণ হয়।
 এরপর কবিগুরু যখন ৬৬  বছর বয়স  তখন তিনি 'শ্যামলী' গৃহ নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। চন্দননগরে থাকাকালীন রবীন্দ্রনাথ অদ্ভুত এক মাটির বাড়ি দেখেন। সেই বাড়ির কথা মাথায় রেখেই বৈজ্ঞানিক চিন্তা ধারায় করে সৃষ্টি হয় শ্যামলীর। ১৯৩৬ সালে প্রবল বৃষ্টিতে শ্যামলীর ছাদ ধসে পড়ে এবং শ্যামলীর সংস্করণ করা হয়।
 শ্যামলীর পর 'পুনশ্চ'। রবীন্দ্রনাথ এক দেওয়ালে আবদ্ধ হয়ে বেশিদিন থাকতে পছন্দ করতেন না। নতুন লেখা তাগিদে তার প্রয়োজন হতো পরিবর্তন, তাই শ্যামলীর পূর্বদিকে আবির্ভাব হলো 'পুনশ্চ'র।
কিন্তু 'উদয়ণ' স্থাপনের পরিকল্পনা করেন রথীন্দ্রনাথ। তিনি যখন ১৯২০ সালের পর সস্ত্রীক শান্তিনিকেতনে বসবাস শুরু করেন তখন ১৯২১ সালে এই নির্মাণ শুরু হয়। ১৯৩৮ সালে জাপানে রীতিতে সাজানো উদয়ণের কাজ সমাপ্ত হয়।
যথারীতি 'পুনশ্চ' তে কিছুদিন থাকার পর সেখানে আর ভালো লাগে না কবির। তাই এবারে শেষ নির্মাণ ঘটে 'উদীচী'র। রাজস্থানী স্থাপত্যের অনুসরণ লক্ষ্য করা যায় এই বাড়িতে। ৭৮ বছর বয়সে চিরতরে হারিয়ে যাওয়ার আগে কবি এই বাড়িতে বসবাস করতেন। এই ছিল তার শেষ গৃহবদল। জীবনের শেষ সৃষ্টিগুলি  এই 'উদিচী'তেই সৃষ্ট।
                  
                           ৫. শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রভবন
                                চিএঋন - Wikipedia

আজ পঁচিশে বৈশাখ তাই আমার জানা সামান্য কিছু তথ্য দিয়ে এই অপরিসীম ব্যক্তিত্বের কিছু অজানা তথ্য জানানোর চেষ্টা করলাম মাত্র।
'চলিয়া যাও তখন মনে বাজে-/ চিনি না আমি, তোমারে চিনি না যে।'  ---- অচেনা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

তথ্যসূত্র উল্লেখ --
  • শান্তিনিকেতন চেনা অচেনা - সুমিতেন্দ্র নাথ ঠাকুর
  • Wikipedia

Wednesday, May 6, 2020

দার্জিলিংয়ের আত্মকাহিনী (প্রথম সংখ্যা)

#মহাকাল মন্দির
দার্জিলিং এর এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভ্রমণ কেন্দ্র।দার্জিলিংয়ের চৌরাস্তা থেকে কয়েক মিনিট হেঁটে মহাকাল মার্কেটের পাশে এই মন্দির অবস্থান করেছে অবজারভেটরি চূড়ায়। শহরের সবচেয়ে উঁচু এই জায়গাটিকে অনেক 'পবিএ পাহাড়' বলে থাকে।
মন্দিরটি হিন্দু স্থাপত্য রীতি অনুসারে তৈরি হয়েছে।প্রথমে এখানে 'দুর্জয় লিঙ্গ' নামের এক মনাসটারী ছিল। যেটি ১৭৬৫ সালে সৃষ্টি হয়েছিল অঞ্চলটি  সিকিমেররাজাদের অধীনে থাকাকালীন। পরবর্তীকালে, বর্তমানের এই মন্দিরটি 1782 সালে সৃষ্টি হয়েছে।এই অঞ্চলে প্রচলিত আছে, যে দার্জিলিংয়ের জনপদ এখান থেকেই শুরু হয়ে ধীরে ধীরে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। 'দুর্জয় লিঙ্গ' মনাসটারীর বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা এই জায়গার নামকরণ করেছেন 'দোজেলিং'। এই 'দোজো' ও 'লিং' দুটি শব্দের অর্থ দেশ 'বজ্রের দেশ'।
আমরা মূল মন্দিরের প্রবেশ দ্বারের কাছেই গিয়ে দেখতে পাই শিবের বাহন নন্দী মূর্তি। এখানে প্রধান আরাধ্য দেবতা শিব। কিন্তু মন্দিরে গর্ভে শিবের পাশাপাশি বুদ্ধমূর্তির অবস্থান রয়েছে। এছাড়া, মূল মন্দিরকে ঘিরে রয়েছে দুর্গা, কালী, গণেশ, হনুমান মন্দির। এছাড়া, সম্পূর্ণ মহাকাল মন্দিরকে ঘিরে রয়েছে অসংখ্য বৌদ্ধ চক্র, ঘন্টা,পতাকা (Prayer flag)।
এই মন্দিরে হিন্দুদের ব্রাহ্মণ পুরোহিত ও বৌদ্ধদের সন্ন্যাসীকে একসঙ্গে নিজ নিজ আরাধ্য ভগবানের অর্চনা করতে দেখা যায়। চারিদিকে উঁচু উঁচু পাইন গাছে ঘেরা এই মন্দিরটি অত্যন্ত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও মনোরম। তাই আপনি দার্জিলিং ভ্রমণের সময় অবশ্যই আসতে পারেন এই মন্দিরে।
এখানে এসে আমরা একজন পুরোহিতের সাথে কথা বলে জানতে পারি শিবরাত্রিতে খুব ধুমধাম করে এখানে উৎসব পালন করা হয়। এছাড়া, বুদ্ধপূর্ণিমাতেও এখানে উৎসব পালন হয়। ওনার কথা শুনে আমার মনে হল দার্জিলিংয়ের এই মন্দিরে ভগবান শিব ও বুদ্ধের অবস্থান যেন দুটি পৃথক পৃথক ধর্মের সহবস্থানকে প্রকাশ করেছে।





Friday, May 1, 2020

'মে দিবস'

মে দিবসের কবিতা
--- সুভাষ মুখোপাধ্যায়
প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য
ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা,
চোখে আর স্বপ্নের নেই নীল মদ্য
কাঠফাটা রোদে সেকে চামড়া।
চিমনির মুখে শোনা সাইরেন-শঙ্খ,
গান গায় হাতুড়ি ও কাস্তে,
তিল তিল মরণেও জীবন অসংখ্য
জীবনকে চায় ভালবাসতে।
প্রণয়ের যৌতুক দাও প্রতিবন্ধে,
মারণের পণ নখদন্তে;
বন্ধন ঘুচে যাবে জাগবার ছন্দে,
উজ্জ্বল দিন দিক্-অন্তে।
শতাব্দী লাঞ্ছিত আর্তের কান্না
প্রতি নিঃশ্বাসে আনে লজ্জা;
মৃত্যুর ভয় ভীরু বসে থাকা, আর না-
পর পর যুদ্ধের সজ্জা।
প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য
এসে গেছে ধ্বংসের বার্তা,
দুর্যোগে পথ হয় হোক দুর্বোধ্য
চিনে নেবে যৌবন-আন্তা।।
আজ 'মে দিবস'। ঐতিহাসিক ভাবে যেমন এই দিনটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন ঠিক তেমনি এই দিনটি সাহিত্যে ক্ষেত্রেও যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। পৃথিবীতে কোনো আন্দোলনের পথ কখনো মসৃণ হয় না। সেই পথের প্রতিটি বাঁকে থাকে নানা ঘটনা, জুলুম, অত্যাচার, ধর্মঘট, মিছিল। তাই এই 'মে দিবস'ও একদিনে পরিণতি পায়নি.. এর পেছনে ছিল দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস। সেই ছবি দেখা গেছে একাধিক সাহিত্যেও।
 তাই সহজ ভাষায় বলতে গেলে এই 'মে দিবস' হল পৃথিবীর মেহনতী মানুষদের সঙ্কল্প গ্রহণের দিন। সেই সঙ্কল্প হলো সামাজিক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে শ্রেণীবৈষম্যের বিলোপ সাধন ও পুঁজিবাদীদের দাসত্বশৃঙ্খল থেকে মুক্তি। এই 'মে দিবস'ই শ্রমিকশ্রেণীতে এনে দিয়েছে চিন্তা ও চেতনার এক বৈপ্লবিক তাৎপর্য।
 আর আজকের এই বর্তমান পরিস্থিতিতে সারা বিশ্বে যখন চলছে এক ভয়াবহ মৃত্যুমিছিল, সকল মানুষ যখন হয়ে রয়েছে গৃহবন্দী। তাই, অর্থনৈতিক বিপর্যয় যখন কড়া নাড়ছে প্রতিটি দেশের দরজায় তখনো সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতি এগিয়ে আসছে এই শ্রমিকশ্রেণীর দিকেই। বিপর্যয়ের প্রথম উপহার স্বরূপ তারাই পাবে বেকারত্ব। কিন্তু, কোনোভাবে যদি সেই বেকারত্বের হাত থেকে বাঁচানো যায় এই বিশ্বকে তবেই সার্থক হবে এই 'মে দিবস'।

Shilajit Resin

Shilajit Resin Tap into your full potential with India’s first clinically researched, purified shilajit resin, sourced from 18,000 feet of t...