সংস্কৃতি সম্পূর্ণ বিশ্বের একটি অপরিহার্য অঙ্গ। পৃথিবীর প্রত্যেকটি দেশের নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে। সেইসব লোকজ উপাদানের গর্ভে জন্ম নেওয়া লোকসংস্কৃতি বর্তমানে প্রায় অবলুপ্ত আবার কোথাও কোথাও তাতে লেগেছে আধুনিকতার হাওয়া। এই তালিকায় বাংলার লোকসংস্কৃতি ও বাদ যায়নি। বিনোদনের নানাবিধ পসরার দৌরাত্ম্যে বাংলার চিরন্তন লোকসংস্কৃতি কি হারিয়ে যাচ্ছে?
বাংলা লোকসংস্কৃতি একটি বিরাট অধ্যায়। মানবজীবনের প্রতিটি পরতে যে বিষয়গুলি পরম্পরায় আবহমানকাল ধরে টিকে রয়েছে তার সবকিছুই লোকসংস্কৃতির উপাদান। আর এই লোকসংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ হলো লোকসংগীত বা লোকগীতি। সংস্কৃতির উপর সংগীতের প্রভাব বিস্তর। মূলত এই সংস্কৃতি গুলি স্থাপন হয়েছিল আঠারো শতকে। গ্রাম-বাংলার লোকসংগীত এর মধ্যে বাউলগান, জারি, সারি, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, মুর্শিদী, গম্ভীরা, লেটোগান, কবিগান ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। গ্রামাঞ্চলের এই লোকসঙ্গীতের সাথে বাদ্যযন্ত্র হিসাবে মূলত একতারা, দোতারা, সারেঙ্গা, খোল, ঢোল, বাঁশী, খমক, মন্দিরা, কাঁসর, ঘণ্টা, মৃদঙ্গ, ডুগডুগি ইত্যাদি ব্যবহার করা হতো।
১. গ্ৰামবাংলার লোকসঙ্গীতের আসর
বাংলার লোকসংগীতের মধ্যে বিভিন্ন ধারার গানের পরিচয় পাওয়া যায়। সেসব গান বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, কতক গান একক কণ্ঠে গীত হতো, আবার কতক সমবেত কণ্ঠে। এদের মধ্যে যেগুলি ব্যক্তিবিশেষ রচয়িতা সেগুলি হল -
১.
বাউল গান - বাউল একটি সাধন-ভজন গোষ্ঠী যারা গ্রামে গঞ্জে ভিক্ষা করে বেড়ায়। এরা দেহভিত্তিক সাধনার অনুসারী। এই সাধনায় সুফি ভাবনার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। বাউলরা মন্দির-মসজিদে যায় না, কোন ধর্মগ্রন্থে তাদের বিশ্বাস নেই, মূর্তিপূজা, বর্ণবৈষম্য, জাতিভেদে তারা বিশ্বাসী নয়, তারা মানবতাবাদী। কেউ কোনোোদিন জন্ম থেকেই বাউল হতে পারে না, গুরুর নিকট দীক্ষা নিয়ে বাউল হতে হয়। এই সাধনা মূলত নারী-পুরুষ মিলিত যুগলসাধনা। তাদের এই সাধনার দর্শন ও মতামতকে তারা গানের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করে থাকে। বাউল মত সতেরো শতকে জন্ম নিলেও লালন সাঁই এর মাধ্যমেই বাউল গান উনিশ শতক থেকে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তিনি শ্রেষ্ঠ বাউল গান রচয়িতা ছিলেন। তিনি প্রায় দু'হাজারের মতো গান বেঁধেছিলেন। রবীন্দ্রনাথও বাউল গান দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। যা পরবর্তীকালে '
তোরা যে যা বলিস ভাই আমার সোনার হরিণ চাই', '
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে', '
গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙ্গামাটির পথ', '
পাগলা হাওয়ায় বাদল দিনে' ইত্যাদি গানের মধ্য দিয়ে লক্ষ্য করা যায়। যা আজও অত্যন্ত জনপ্রিয়।
২.গ্ৰামের বাউল গান
২.
ভাটিয়ালি - বাংলার লোকসংগীতে ভাটিয়ালি ভাটি অঞ্চলের অত্যন্ত জনপ্রিয় সংগীত। যা বিশেষ করে নদ-নদী পূর্ণ বাংলাদেশের কিছু কিছু অঞ্চলে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। এই গানগুলো মূলত প্রকৃতিতত্ত্বের গান। এই গানের মূল বৈশিষ্ট্য এগুলি রচিত হয় মূলত মাঝি, নৌকো, দাঁড় ইত্যাদি বিষয়ে। সাথে থাকে গ্রামীণ জীবন, গ্রাম্য নারীর প্রেম, বিরহ, আকুলতা ইত্যাদি। এই ভাটিয়ালি গান এই দেশের প্রানের চেতনা থেকে উৎসারিত। যেহেতু গানগুলি অপটু হাতে রচিত তাই গানগুলি গুণগত মান উন্নত না হলেও গ্রাম্য জীবনে এই গানের প্রচলন ছিল অত্যধিক। নদীর স্রোতের টানে নৌকো নিয়ে যাওয়ার সময় এই গানগুলো গাওয়া হতো। কিন্তু বর্তমান যুগে এই ভাটিয়ালি গানকে এমনভাবে চোখে ধরা পড়তে দেখা যায় না। এই ভাটিয়ালি গানের অন্যতম রচয়িতা হলেন রশিদ উদ্দিন, জালাল খাঁ, কবি নিবারণ পণ্ডিত।
৩.ভাটি অঞ্চলের ভাটিয়ালি গান
৩.
মুর্শিদি - এই মুর্শিদি গান এক প্রকার আধ্যাত্বিক লোকসংগীত। সুফিদের দ্বারা এর উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছে। 'মুর্শিদি' শব্দটি আরবি, এর শব্দমূল 'এরশাদ', অর্থ হলো আদেশ উপদেশ দেওয়া। যিনি ভক্তকে আদেশ উপদেশ দেন এবং তাকে আধ্যাত্মিক পথে পরিচালিত করে তাকে বলে মুর্শিদি। এই মুর্শিদিকে সরাসরি সম্মোধন করে ভক্ত আত্মনিবেদন করে থাকে গানের মাধ্যমে। ভক্ত আপনভাবে বিভোর হয়ে যে গান গায়, তার সেই গানের মধ্য দিয়েই প্রকাশিত হয় তার দুঃখ বেদনার কথা প্রার্থনার আকুলতা সেই গানকে মুর্শিদি গান বলা হয়। মুর্শিদের গুনগান ছাড়া এতে নৌকো, পাখি, রাধাকৃষ্ণের প্রেম ইত্যাদি বর্ণনা করা হয়। অন্য কোনো জটিল তত্ব নেই এই গানে। এখানেই এই গান স্বতন্ত্র। বর্তমানে বাংলাদেশে আজও এই গানের অস্তিত্ব রয়েছে। কয়েকটি বিখ্যাত মুর্শিদি গান হল - '
দয়াল আমার কান্ডারী হইও রে' অথবা
'তুমি দাও দেখা দরদী রে আমায়'।
৪. সুফিদের দ্বারা প্রস্তুত মুশিদি গান
৪.
ভাওয়াইয়া - এই গান দিয়ে মূলত মনের ভাব প্রকাশ করা হত। এই গান পশ্চিমবঙ্গের উত্তরের পার্বত্য অঞ্চলে এবং আসামের পার্বত্য অঞ্চলে, বাংলাদেশের রংপুর অঞ্চলের গোয়ালপাড়ার মধ্যে প্রচলিত ছিল। এই ভাওয়াইয়ার মূল বৈশিষ্ট্য, এই গানগুলিতে পারিবারিক স্মৃতির ছবি, বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দৃশ্যপট, জনজীবনের জীবনযাত্রা, কর্মজীবন ইত্যাদি ছবি ফুটে উঠত। বাংলার উত্তরাঞ্চলের নদ-নদী কম থাকায় সেখানে রাস্তায় গরুর গাড়ি দ্বারা চলাচল করতে হতো। এই গরুর গাড়ির গাড়োয়ান গাড়ী চলা অবস্থায় আপন ভাবাবেগে কাতর হয়ে গান করত। উঁচু নিচু রাস্তায় গরুরগাড়ির চাকা পড়লে তার গানের সুরের মধ্যেও ভাঁজ পড়ত। এই সুরে ভাঁজ পড়ার রীতি ভাওয়াইয়া গানের এক লক্ষণীয় বিষয় যা এই গানকে অন্যান্য লোকসংগীত এর মধ্যে পৃথক করেছে। কবি আব্বাসউদ্দিনকে এই 'ভাওয়াইয়া গানের সম্রাট' বলা হয়।
৫. বাংলার ভাওয়াইয়া গান
উপরিউক্ত সমস্ত প্রকার গানগুলি একক কণ্ঠে গাওয়া হতো, তা থেকেই গানগুলি রচিত হত। কিন্তু লোকসঙ্গীতের বিরাট একটি অংশের গান গাওয়া হতো সমবেত ভাবে অথবা কখনো কখনো নৃত্য নাটকের সাথে এই জাতীয় সংগীতগুলি পরিবেশন করা হত। সেগুলি হল -
১.
কবিগান - কবিগান বাংলার লোকসংস্কৃতির একটি বিশেষ ধারা। মধ্য যুগে এই কবিগানের উদ্ভব হলেও ১৭৬০ থেকে ১৮৩৭ সালের মধ্যবর্তী সময়ে এই কবিগানের প্রকৃত বিকাশ ঘটে। এই ধারায় প্রতিযোগিতামূলক গানের আসরে অংশগ্রহণ করে থাকেন। যিনি গায়ক হন তিনি মুখে মুখে পদ রচনা করেন এবং তাৎক্ষণিকভাবে সুরারোপ করে থাকেন। এই গায়ককেই কবিয়াল বলা হয়। কবিয়ালের সহকারি গায়ককে দোহার বলে। এই প্রতিযোগিতায় কবিয়াল মুখে মুখে গান বেঁধে অপর পক্ষের কবিয়ালকে আক্রমণ করেন এবং তিনিও গানের মাধ্যমেই সেই আক্রমনের প্রতি উত্তর দেন।
আজ অবধি প্রায় একশ'র বেশি কবিয়াল কবিগানের বিকাশে অবদান রেখেছেন। তাদের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন হলেন গোজলা গুঁই, রাম বসু, ভবানী, ভোলা ময়রা, নিধুবাবু, মুকুল দত্ত, বিজয় সরকার প্রমুখ। এছাড়া, একজন পর্তুগিজ বণিকও বাংলার নামজাদা কবিয়াল হয়েছিলেন। তিনি হলেন অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি। এই অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির একটি বিখ্যাত পংক্তি যা তিনি ভোলা ময়রাকে গানের জবাব দিয়েছিলেন -
"খ্রিস্ট আর কৃষ্ণে কিছু প্রভেদ নাই রে ভাই
শুধু নামের ঘোরে মানুষ ফেরে,
এত কথা শুনি নাই।"
কিন্তু পরবর্তীকালে এই কবিগানের অবনমন ঘটে। এটি রূচিহীনদের সময় কাটানোর অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়ায় এবং জমিদারি প্রথার অবসানের সঙ্গে সঙ্গে এই কবিগানের ঐতিহ্যও ধীরে ধীরে মুছে যায়।
৬. বাংলার কবিগানের আসর
২.
জারি গান - জারি গান বাংলার এক ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীতরীতি। ফরাসিতে 'জারি' শব্দের অর্থ শোক। সতেরোশো শতক থেকে বাংলায় এই গানের ধারা শুরু হয়। ইসলামের ইতিহাসভিত্তিক নাট্যধারায় এই জারিগান সর্বাধিক জনপ্রিয়। মহরমের মাসে কারবালার দুঃখজনক কাহিনীর দ্বারাই এই গানের উদ্ভব ঘটেছিল। কারবালার যুদ্ধের অন্তর্গত বেদনার কথাই এক ধরনের সুর, নৃত্য দ্বারা এই গানের পরিবেশিত হতো। এছাড়াও যেকোন ধর্মীয় ও সামাজিক বিষয় নিয়েও কখনো কখনো জারিগান রচিত হত। কোথাও কোথাও আবার কবিগানের এক ভিন্ন রূপকেও জারি গান বলা হয়।একসময় সমগ্র বাংলায় এই গানের প্রচলন ছিল এমনকি শান্তিনিকেতনে এই জারি গান অনুষ্ঠিত হতো। কিন্তু বর্তমানে এই ধরনের নাট্য পরিবেশনার প্রচলন পূর্বের ধারাবাহিকতা চেয়ে কিছুটা কমে গেলেও একেবারে অবলুপ্তি ঘটেনি।
৭. মহরমের সময় পরিবেশিত জারিগান
৩.
সারি গান - সারিগান বাংলার লোকসংগীত গুলির মধ্যে অন্যতম। সারিগান মূলত মাঝিরা গাইলেও অনন্য শ্রমজীবীদের মধ্যেও তার প্রচলন ছিল। নৌকার মাঝিরা একে অপরকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য এই ধরনের গান গাইত। নৌকাবাইচের সময় প্রতিটি নৌকার যে প্রধান মাঝি থাকে, তিনি এই গানের মূলপদটি গাইতেন। অন্যান্য মাঝিরা তার সাথে সুর দিতেন দলবদ্ধভাবে। তবে প্রত্যেকেই নৌকার গতি ও তাল মিলিয়ে গান গেয়ে ও সুর দিয়ে যান। প্রাচীনকাল থেকেই যেসব উৎসব পালন হয় তাদের মধ্যে অন্যতম হলো নৌকাবাইচ উৎসব। বর্ষাকালে উৎসবের সময় এই গান ছিল এই উৎসবের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
৮. নৌকোবাইচের সময় গীত সারিগান
৪.
গম্ভীরা - লোকসঙ্গীতের এক প্রাচীন ধারা হলো 'গম্ভীরা'। এই গম্ভীরার উৎপত্তি হয়েছে মূলত মালদহ জেলায় কিন্তু তৎকালীন সমগ্র বাংলা জুড়েই ছিল এর বিস্তৃতি। এই গম্ভীরা শব্দের অর্থ হলো শিবের মন্দির বা গাজন ঘর। শিবের এক নাম হলো গম্ভীর। একসময় এই শিবের পুজোয় বন্দনা করে যে গান গাওয়া হতো তাকে বলে গম্ভীরা। এই গম্ভীরা একত্রে দলবদ্ধভাবে গাওয়া হত। মধ্যযুগের সনাতনধর্মীদের প্রধান পূজ্যো দেবতা ছিলেন মহাদেব। তাই এই শিব পূজোকে ঘিরে প্রায় সারা বছর ধরেই নানা উৎসব পালন করা হতো। তখন পালা-অভিনয় ও গম্ভীরা গানের মাধ্যমে সমাজের সমস্যা গুলি তুলে ধরা হতো। বর্তমানে চৈত্রসংক্রান্তিতে বাংলার গ্রামীণ অঞ্চলের উৎসবে এই পালা-গম্ভীরা পরিবেশনা হয়ে থাকে। এই গম্ভীরার উল্লেখযোগ্য শিল্পী হল রকিবউদ্দিন, বীরেন ঘোষ প্রমূখ।
৯. উৎসবে অনুষ্ঠিত গম্ভীরা
এই একক কণ্ঠে গীত এবং সম্মিলিত কণ্ঠে গীত গান ছাড়াও গ্ৰামবাংলায় কিছু আঞ্চলিক লোকসংগীত এর অস্তিত্ব পাওয়া যায়। যেমন, পাহাড়ি অঞ্চলে ঝুমচাষ করার সময় তারা এক প্রকার সংগীত করত। লালমাটি অঞ্চলে ভাদু উৎসব, টুসু উৎসবেও একপ্রকার পাঁচালী গীত গাওয়া হতো। এছাড়া আধিবাসীদের উৎসবের সময় তারা প্রাচীন লোকসংগীত দ্বারা নৃত্য পরিবেশন করত। সেইসব সুরও বাংলার লোকসংগীতকে প্রভাবিত করেছে।
কয়েকশো শতকের ঐতিহ্য ধারণকারী বাংলার লোকসংস্কৃতির সবচেয়ে জনপ্রিয় শাখা হলো লোকসংগীত। ঐতিহাসিক কাল থেকেই বাংলার মানুষ সঙ্গীতপ্রিয়। তাই প্রাচীনকালে এই লোকগীতি মানুষের সেই সঙ্গীত পিপাসু হৃদয়কে শান্ত করে এসেছে, একসময় এই লোকগীতি বেতারের মাধ্যমে প্রচার হতো যা শুনে গ্রামের সাধারণ মানুষ থেকে শহরের মধ্যবিত্ত মানুষ সবাই আনন্দ পেয়েছে। কিন্তু বর্তমানে লোকগীতির আসর খুবই কম দেখা যায়। বরং এই বিশ্বায়নের যুগে আমাদের সংগীত বাইরের দেশের সংগীত দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে। তাই আমাদের উচিত নিজেদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বজায় রেখে লোকসংস্কৃতি পুনরায় উজ্জীবিত করা। মনে রাখা প্রয়োজন আমাদের সমাজের শিকড় এই লোকসংস্কৃতি। তাই সমাজকে সজীব রাখতে শিকড়ের প্রতি যত্ন নেওয়া আমাদের দায়িত্ব।
তথ্যসূত্র -
- বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস - অসিত কুমার বন্দোপাধ্যায়
- বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস - দেবেশ কুমার আচার্য
- উইকিপিডিয়া
- বাংলাপিডিয়া